মূল্যস্ফীতির তুলনায় বাড়ছে না মজুরি, তীব্র সংকটে শ্রমজীবীরা

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, গত কয়েক বছর ধরে শ্রমিকদের মজুরি বাড়লেও, গত ২৬ মাস ধরেই তার পরিমাণ মূল্যস্ফীতির হারের নিচে।
ডিম, আলু, পেঁয়াজ, নিত্যপণ্য মূল্য, মূল্যস্ফীতি,
প্রতীকী ছবি। অলঙ্করণ: বিপ্লব চক্রবর্তী

মূল্যস্ফীতির কারণে বাংলাদেশে জীবনযাত্রার ব্যয় যেভাবে বেড়ে চলেছে, তাতে সবচেয়ে বেশি সংকটে পড়েছেন দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে কাজ করা শ্রমিকরা।

গত দুই বছরের বেশি সময়ে তাদের যে পরিমাণ মজুরি বেড়েছে, তা মূল্যস্ফীতির হারের চেয়ে অনেক কম।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, গত কয়েক বছর ধরে শ্রমিকদের মজুরি বাড়লেও, গত ২৬ মাস ধরেই তার পরিমাণ মূল্যস্ফীতির হারের নিচে।

এর অর্থ হলো, শ্রমজীবীরা একটি অনিশ্চিত অবস্থার মধ্যে আছেন। প্রকৃত আয় হ্রাস এবং জীবনযাত্রার ব্যয় ক্রমশ বৃদ্ধির মধ্যে তাদের মতো নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোকে দৈনন্দিন ব্যয় কমাতে বাধ্য হতে হচ্ছে।

গত মার্চ মাসে নিম্ন ও অদক্ষ শ্রমিকদের মজুরি বেড়েছে ৭ দশমিক ৮০ শতাংশ। কিন্তু, মার্চে ভোক্তা মূল্য সূচক (সিপিআই) বেড়েছে ৯ দশমিক ৮১ শতাংশ।

অর্থাৎ, বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী মূল্য সূচক বৃদ্ধির তুলনায় মজুরি বৃদ্ধি ২ দশমিক ০১ শতাংশ পয়েন্ট কম রয়ে গেছে।

বিবিএসের মজুরি হার সূচকে কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতের ৪৪টি অনানুষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের মজুরি বিবেচনা করা হয়, যারা দৈনিক ভিত্তিতে মজুরি পেয়ে থাকেন।

দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে আলাপকালে পটুয়াখালীর এক নির্মাণশ্রমিক বশির তালুকদার বলেন, সীমিত আয়ে তার ছয় সদস্যের পরিবারের ব্যয় চালানো কঠিন হয়ে পড়ছে।

তিনি দৈনিক ৭৫০ টাকা মজুরিতে কাজ করেন, যা পরিবারের দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় ব্যয় মেটানোর জন্য পর্যাপ্ত নয় বলে মনে করেন তিনি।

বশির বলেন, 'আমার ১৪ বছরের ছেলেকে আমার সঙ্গে নির্মাণশ্রমিক হিসেবে কাজে নিতে বাধ্য হয়েছি। ছেলের দৈনিক মজুরি ৬০০ টাকা।'

'আমি একা যা আয় করি তা দিয়ে পর্যাপ্ত চাল, শাকসবজি, মাছ, ডাল, লবণ কেনা কঠিন। বছরে একবারও মাংস কেনার টাকা থাকে না,' বলেন তিনি।

'যদি একদিন কাজ না পাই, ক্ষুদ্র সামান্য সঞ্চয়ে হাত দিতে হয়,' যোগ করেন তিনি।

পটুয়াখালীর কুয়াকাটা এলাকার মৎস্যজীবী বাচ্চু কাজী ডেইলি স্টারকে বলেন, আয় কম হওয়ায় ঈদুল ফিতরে তার পাঁচ সদস্যের পরিবারে  কোনো আনন্দ ছিল না।

তিনি বলেন, 'নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম হু হু করে বেড়েছে। একটা কিনলে আরেকটা কেনা যায় না।'

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে স্থানীয় মুদ্রার বিনিময় হারের পতন, অপর্যাপ্ত নীতি এবং দুর্বল বাজার ব্যবস্থাপনার কারণে ২০২২ সালের মে থেকে বাংলাদেশের নিম্ন-আয়ের জনগোষ্ঠী ক্রমাগত চাপের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। একই সময় থেকে বেড়েই চলেছে মূল্যস্ফীতির হার।  

ভোক্তা মূল্য সূচক গত অর্থবছরে ১২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ ৯ দশমিক ০২ শতাংশে পৌঁছায়। চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে বৃদ্ধির এই প্রবণতা অব্যাহত আছে।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ধারণা, জুনে অর্থবছর শেষের সময় বাংলাদেশের গড় মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৩ শতাংশের বেশি থাকবে।

গবেষণা সংস্থা ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইএনএফ) নির্বাহী পরিচালক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মুস্তাফা কে মুজেরী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যে মানুষ যেন হেরে যাওয়া যুদ্ধে লড়াই করে চলেছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি চললে নিম্ন-আয়ের মানুষদের ক্রয়ক্ষমতা সীমিত থাকে।'

তিনি বলেন, 'যেহেতু জনগণের ক্রয় ক্ষমতা ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে, তাদের পরিস্থিতি মোকাবিলা করার ক্ষমতা ধীরে ধীরে কমে আসছে এবং তারা শেষ প্রয়োজনটা মেটাতে লড়াই করছে।'

'তারা খরচ কমিয়েছে এবং পরিবারের সদস্যদের জন্য স্বাস্থ্যকর খাদ্য নিশ্চিত করতে পারছে না। তাদেরকে সঞ্চয় ভাঙতে হচ্ছে,' বলেন তিনি।

বিশ্বব্যাংক সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে বলেছে, ক্রয়ক্ষমতা হ্রাসের কারণে ২০২২-২৩ থেকে ২০২৩-২০২৪ সালের মধ্যে বাংলাদেশের প্রায় ৫ লাখ মানুষ চরম দারিদ্রের মধ্যে পড়েছে।

মৎস্যজীবী বাচ্চু কাজী বলেন, 'আমাদের মতো গরিব মানুষের কথা কেউ ভাবে না।'

মুস্তাফা কে মুজেরী মনে করেন, 'বর্তমানে মূল্যস্ফীতি কমার কোনো সম্ভাবনা নেই।'

'উচ্চ মূল্যস্ফীতি স্বাস্থ্য ও শিক্ষার ওপর দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তাই সরকারের উচিত আগামী বাজেটে বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া।'

'সরকারকে অবশ্যই পরিমাণ এবং গুণমান উভয় ক্ষেত্রেই সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতা প্রসারিত করতে হবে,' বলেন এই অর্থনীতিবিদ।

Comments

The Daily Star  | English

The story of Gaza genocide survivor in Bangladesh

In this exclusive interview with The Daily Star, Kamel provides a painful firsthand account of 170 days of carnage.

1d ago